মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন কে কে
মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন কে কে ছিলেন এ বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। মুজিবনগর সরকার কি, মুজিবনগর সরকার কেন গঠন হয়েছিল এবং মুজিবনগর সরকরের সদস্য সম্পর্কে জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দমন-পীড়নের পন্থা অবলম্বন করে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে“অপারেশন সার্চলাইট” নামে গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আগেই কিছু্টা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও জানতেন তাকে গ্রেফতার করা হবে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে ইপিআরের ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। পরবর্তীতে মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ চট্রগামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা, দেশকে স্বাধীন করা, আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় মুজিবনগর সরকার বা বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।
মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রেক্ষাপটঃ
২৫শে মার্চ পাক বাহিনী দেশে গণহত্যা শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। এদিকে তাজউদ্দিন আহমদ আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপন করেন। ৩১শে মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী এর সহযোগিতায় বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌছেন। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর তৎকালীন আইজি গোলক মজুমদার তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। গোলক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে বিএসএফ এর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজি তাজউদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাজউদ্দিন কেএফ রুস্তামজির নিকট বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও ভারতীয় সামরিক সহযোগিতা চাইলে তিনি জানান ভারতের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমুতি ছাড়া একাজ আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাজউদ্দিন ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে দিল্লি পৌছান। সেখানে পৌছে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সহ অনেক উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দিনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠনের জন্য উপদেশ দেন।
মুজিবনগর সরকার গঠনঃ
মুক্তিবাহিনী গঠন ও সমন্বয়, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ে সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। তাজউদ্দিন বুঝতে পারেন বিদেশী সহায়তার জন্য সরকার গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বেদ্যনাথ তলায় অধিবেশন আহবান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও শসস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানিকে প্রধান সেনাপতি করে মোট ছয় সদস্য বিশিষ্ট মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। পরের দিন ১১ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষনা দিয়ে জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহন করে।
এক নজরে মুজিবনগর সরকারের সদস্য কে কে ছিলেনঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। | রাষ্ট্রপতি |
সৈয়দ নজরুল ইসলাম। | উপরাষ্ট্রপতি
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকায় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। |
তাজউদ্দীন আহমদ | প্রধানমন্ত্রী। প্রতিরক্ষা, তথ্য ও সম্প্রচার, সংস্থাপন এবং যে সকল মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব অর্পন করা হয় নি। |
এম মনসুর আলী | অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়। |
খন্দকার মোশতাক আহমদ | পররাষ্ট্র, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়। |
এএইচএম কামরুজ্জামান | স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রনালয়। |
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা বিস্তারি মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীরা কোথায় এবং কিভাবে আশ্রয় পেয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট কেন গঠিত হয়েছিল ২৭/১২/১৯৭১ সালে মন্ত্রিসভাকে আরও সম্প্রসারিত করে আরও পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়ে দপ্তর বন্টন করা হয়।
সম্প্রসারিত মুজিবনগর মন্ত্রিসভার সদস্য ও দপ্তর তালিকাঃ
শেখ আব্দুল আজিজ | যোগাযোগ মন্ত্রনালয়। |
ফণী ভূষণ মজুমদার | কৃষি, খাদ্য ও স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়। |
আব্দুস সামাদ আজাদ | পররাষ্ট্র |
জহুর আহমেদ চৌধুরী | স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যান ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়। |
এম ইউসুফ আলী | শিক্ষা মন্ত্রনালয়। |
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রধান সেনাপতি করা হয় লে. জেনারেল এম এ জি ওসমানিকে। প্রধান সচিব রুহুল কুদ্দুস এবং কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতাস্থ দূতাবাসে এম হোসেন আলী, দিল্লীতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং নিউইয়র্ক দূতাবাসে এ এইচ এম মাহমুদ আলী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়।
এই সরকার গঠনের ফলে বিদেশী আর্থিক এবং কূটনৈতিক সহায়তা আসতে শুরু করে। বিদেশী সাংবাদিক ও কূটনৈতিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত সংঘটিত হয়। মুজিবনগর সরকার গঠনের ফলে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের যোদ্ধার স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রাণপন লড়াইয়ে নবশক্তি ফিরে পায়। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মুজিবনগর সরকার কার্যকর ছিল।
মুজিবনগর সরকার সম্পর্কিত প্রশ্নাবলিঃ
মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় এই মন্ত্রিসভার সদস্য কতজন ছিলেন?
১৯৭১ সালের ১০ এ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন ছয়জন। পরবর্তীতে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভায় আরও পাঁচজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে সবমিলে মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হয় মোট ১১ জন।
মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করে করে কে?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ
মুজিব নগর সরকারকে শপথ বাক্য পাঠ করান কে?
অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী।
মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর কোথায় ছিল?
৮ নং থিয়েটার রোড, কলাকাতার একটি ভবনে।
জাতীয় চার নেতা বলতে কাদের বলা হয়?
জাতীয় চার নেতারা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান। এই চার নেতাকে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ দিনটিকে জাতীয় জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন: জাতীয় চার নেতার নাম ও পদবী অপারেশন সার্চলাইট এর নীল নকশা কে তৈরি করেন অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর বিশ্বে কীভাবে ছড়িয়েছিল সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান সাইমন ড্রিং কোন দেশের নাগরিক মুক্তিযুদ্ধে সংগীত শিল্পীদের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেখুন এই পোস্টে।