Site icon

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

সাইমন ড্রিংঃ

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান
চিত্র: সাংবাদিক সাইমন ড্রিং

সাইমন ড্রিং ১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি কাজ করেছেন দি রয়টার্স, দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি এর মতো বিখ্যাত সব সংবাদমাধ্যম। বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা মহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিপ্লব, শোষন-বেষম্য ও সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দৈনিক তরতাজা খবর তৈরি করতেন ও দীর্ঘ প্রতিবেদন রচনা করতেন। তিনি তার সমগ্র সাংবাদিকতা কর্মজীবনে ২২টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ ও কাভার করেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, হাইতিতে আমেরিকার আগ্রাসন, ইরানের শাহ বিরোধী গণ-অভ্যূত্থান এর মতো বিষয় সাইমন ড্রিং বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকাঃ

১৯৭১ সালের ‍মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সংবাদ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারীদের ধর্ষন ও শরণার্থীদের দুর্ভোগ পাকিস্তানিরা বিশ্বের কাছে আড়াল রাখতে চেয়েছিল এমনকি খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারন জনগন জানতেন না পূর্ব পাকিস্তানে কি চলছে।  যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী অসংখ্য বাঙালি সাংবাদিককে  হত্যা করেন। বাংলাদেশের গণহত্যার খবর যেন বহির্বিশ্বে প্রকাশ না পায় সেজন্য  বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এ সময় জীবন বাজি রেখে অনেক বিদেশি সাংবাদিক যুদ্ধকালীন সংবাদ সংগ্রহ করেছেন এবং তা বহির্বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এতে বহির্বিশ্ব প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছে। আমাদের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারকৃত এসব খবর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছে। সাংবাদিকদের সেসব আলোকচিত্র, ডকুমেন্টরি ও ভিডিও ফুটেজ সময়ের পরিক্রমায় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের  প্রামাণ্য দলিল। 

উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানে সাইমন ড্রিংয়ের আগমনঃ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিং লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া অঞ্চলে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছিলেন। হটাৎ করে তাকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলী করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সাংবাদিক সাইমন ড্রিং এর তেমন কোন ধারনাই ছিল না। ১৯৭১ এর ৬ই মার্চ তিনি ঢাকায় আসলেন। প্রথম ধাপে সপ্তাহখানেক থাকার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ঢাকায় পা দিলেন। 

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ প্রত্যক্ষ করলেন সাইমন ড্রিংঃ

পরদিন ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষন প্রত্যক্ষ করলেন। সাইমন ড্রিং বাংলা ভাষা জানতেন না। কিন্তু ৭ই মার্চ তিনি জনতার স্রোত, জনগনের উৎসাহ-উৎকণ্ঠ এবং তাদের শরীরি ভাষা ও মুখের চাহনি দেখে বুঝলেন এখানে ঐতিহাসিক কিছু ঘটতে চলেছে। তিনি ৭ই মার্চ শুধু একটি কথা বুঝলেন, এখানকার লোক “জয় বাংলা” চায়। 

ঢাকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষনঃ

সপ্তাহ খানেকের জন্য ঢাকায় আসলেও তিনি ঢাকা ত্যাগ না করে বরং এখানে আরও কিছু সময় থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর তিনি ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে লাগলেন। পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেও তার ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ হয়। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছু দিন। 

ক্ষণে ক্ষনে ঢাকার পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। রাজপথে প্রতিনিয়ত মিটিং-মিছিল, পথসভা ও জনসভা করছে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ। জনতাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা অধিকারের জন্য লড়ছে। পুরো দেশ আন্দোলনে স্ফূলিংগে পরিণত হয়েছে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান সাধারন নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করছে। 

 সাইমন ড্রিং লক্ষ করলেন এরই মধ্যে মার্চের ১৬ তারিখ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলেন। শেখ ‍মুজিবুরের সাথে দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানালেন আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। তারা (পশ্চিম পাকিস্তানিরা) ক্ষমতা ছাড়তে চান না। সাইমন ড্রিং জানতে পারেন ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ রাতেই ঢাকা ছাড়ছেন। এবার সাইমন ড্রিং আন্দাজ করলেন ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে এখানে।

২৫শে মার্চের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করলেন সাইমন ড্রিংঃ

তিনি উঠেছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে হোটেল শেরাটন)।  ২৫ মার্চ রাতে সকল বিদেশি সাংবাদিক ও অতিথিদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একত্রিত করে মিলিটারি নিরাপত্তায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ সাংবদিকরা হোটেল কক্ষ থেকেই মুহুর্মুহু গোলাবর্ষনের শব্দ, আগুনের ফুলকি দেখতে পান। সাইমন ড্রিং বুঝতে পারেন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সিদ্দিক সালিক দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আপনাদের জরুরী ভিত্তিতে দেশ ত্যাগ করতে হবে একথা বলেই পরদিন সকালেই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের জোরপূর্বক বিমানে তুলে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। 

 সাইমন ড্রিং পাকিস্তানি সেনাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলের একটি কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। কারফিউ উঠে গেলে ২৭ মার্চ ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ঢাকার অলি-গলি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে গণহত্যার তথ্যচিত্র ও ফুটেজ সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে নিরাপত্তার স্বার্থে বৃটিশ হাইকমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন। বিমানবন্দরে তাকে হেনস্তা করা হয়। উলঙ্গ করে তাকে তল্লাশি করা হয়। তার ক্যামেরা জব্দ করে নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তিনি পায়ের মোজার ভিতরে কিছু তথ্য লুকিয়ে রাখেন। ঢাকা থেকে ব্যাংকক যান। সেখান থেকে লন্ডনের “দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখা পাঠান 

“Tank Crush Revolt in East Pakistan” নাম ঐতিহাসিক প্রতিবেদন প্রকাশঃ

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান
সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

সাইমন ড্রিং ঢাকার গণহত্যার যে বিভিীষিকা প্রত্যক্ষ করেছেন তা “Tank Crush Revolt in East Pakistan” by Simon Dring নামে প্রকাশ করলেন।  সাইমন ড্রিং লেখেন “আল্লাহর নামে অখন্ড পাকিস্তান রক্ষায় পাকিস্তানি গণহত্যায় ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী। এখানে চারদিকে শুধু ধ্বংসলীলা চোখে পড়ে যা পাকিস্তানি গণহত্যার সাক্ষ্য বহন করে। ২৪ ঘন্টায় এখানে সহস্র মানুষ মারা গেছে। নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর এ বর্বরতা চালানো হয়। এখানকার বর্বরতা জার্মান নাৎসি বাহিনী কিংবা বিশ্বের সকল বর্বরতার সীমাকে অতিক্রম করেছে। ঢাকা যেন এক মৃত শ্মশানে পরিনত হয়েছে। ঢাকা এখন এক ভূতুড়ে নগর”। 

তার সেই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক ফোরামে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যার বিষয়টি নিন্দিত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠিত হয়। সাইমন ড্রিং ব্যংকক থেকে লন্ডনে ফিরে যান। লন্ডন থেকে তিনি আবার কলকাতায় আসেন। বাঙালি শরণার্থী শিবিরের খবর বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াকু অভিযান ও পাকিস্তানের বর্বরতা তুলে ধরেন। এসব খবর নিয়ে বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কলমসৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লিখতে থাকেন। বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। পাকিস্তানের ঘৃণ্য কর্ককান্ড বিশ্বের কাছে উন্মেচিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারার অনুপ্রাণিত হয় । সাইমন ড্রিং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর সাথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছিলেন সাইমন ড্রিং। বাংলাদেশের বিপদে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দেন এই সাইমন ড্রিং। 

Exit mobile version