মুক্তিযুদ্ধে সংগীত শিল্পীদের অবদানঃ
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু এই স্বাধীনতা লাভের পথ এতটা সহজ ছিল না। সব শ্রেণি পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা আমাদের মুক্তির পথকে ত্বরান্বিত করেছিল। আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধে সংগীত শিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গান রচনা ও পরিবেশনা করেছেন যেগুলো যুদ্ধে সৈনেকদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঝিমিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় নবশক্তিতে শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। গানের চেতনায় দেশকে ধারন করেছিলেন। সবার ঊর্ধ্বে মাতৃভূমি আর এই মাতৃভূমি রক্ষায় তারা একের পর এক কালজয়ী সঙ্গীত রচনা করেছেন সেই যুদ্ধকালীন সময়ে। সেই সঙ্গীতের ভাষা মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল। অন্তরে অণুরণন সৃষ্টি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের রুদ্ধশ্বাস ও যন্ত্রণাকাতর দিনগুলোতে এই সংগীত যোদ্ধাদের বাঁচার আশা জাগিয়ে রেখেছিল।
“জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই” সিকান্দার আবু জাফরের এই গানটি
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণভাবে অনু্প্রানিত করেছে। তিনি দিশের ভীষন সংকটের মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলমসৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। “তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া, তুমি বাংলা ছাড়ো” “আমার অভিযোগ” এর মতো রচনা মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধাদের জন্য শক্তিমান বাণী রূপে কাজ করতো। চেতনাদ্দীপ্ত এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গতিশীল করেছেন।
গোবিন্দ হালদার বাংলাদেশের মু্ক্তিযুদ্ধে একজন প্রেরণাদায়ক শিল্পীরূপে ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রান সঞ্চার জাগিয়ে রাখার জন্য বেশ কয়েকটি গান তৈরি করেছিলেন। তার বেশ কিছু গানের মধ্যে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা” “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”, “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে” “লেফট রাইট, লেফট রাইট, হুশিয়ার হুশিয়ার”, “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “চলো বীর সৈনিক”, “বাংলার সৈনিক” ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে বাংলাদেশ বেতারে গোবিন্দ হালদারের “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না” গানটি বাজানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের প্রাণ ভোমরাকে যুদ্ধের জন্য নতুন করে জাগিয়ে তুলতেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপক প্রাণশক্তি।
আব্দুল জব্বারের সহশিল্পী আব্দুল হাদী বলেন, আব্দুল জব্বার ও আমি একসঙ্গে বেতারে কাজ করেছি এবং দিনের পর দিন এসকঙ্গে অনেক আড্ডা দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা “শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাম সালাম হাজার সালাম, জয় বাংলা বাংলার জয় সহ অনেক দেশাত্মবোধক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ভারতীয় কণ্টশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেছেন। ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে ঘুরে গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান পরিবেশন করে প্রাপ্ত ১২ লক্ষ টাকা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দেন।
সংগীত শিল্পী ও গায়ক আপেল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধে তার বিখ্যাত গান “তীর হারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিবো রে” “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” দুটি কালজয়ী গান রচনা করেন। তিনি শুধু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নয় অস্ত্রধারী যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। গান কিভাবে মুক্তিকামী মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে তিনি যেন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
এদিকে কবি আসাদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে অনন্য অবদান রেখেছেন।
৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় সংগীত শিল্পীরাও পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শব্দযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সেই সময়কার পশ্বিমবাংলার বিখ্যাত সব গীতিকারা যেমন, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, গোবিন্দ হালদার, মীরাদেব বর্মণ, বিশ্বনাথ দাস, বাপ্পী লাহিড়ীরা। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার লিখলেন বিখ্যাত গান “শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি”। গানটির সুর করেন অংশুমান রায়। আকাশবানী আর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হতো এই গানটি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গানটি ছিল বিপ্লবের মূলমন্ত্র।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জীবনের প্রাণ হয়ে ওঠেছিল। প্রতিদিনিই নতুনভাবে প্রাণের সঞ্চার জাগ্রত হতো দেশাত্মবোধক ও বিদ্রোহাত্মক গানের মাধ্যমে।
নজরুলের “কারার ঐ লৌহ কপাট, কররে লোপাট” “বল বীর চির উন্নত মম শীর” যোদ্ধাদের মনে বিদ্রোহের দামামা ছড়িয়ে দিতো। ক্লান্ত স্থবির শরীর ও মন আবার চাঙ্গা হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তো। মুক্তিযোদ্ধারা যেন সংশপ্তক।
নিউইয়র্কে জর্জ হ্যারিসন এবং পণ্ডিত রবি শংকর ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়োন রাসেন, ব্যাড ফিঙ্গার এবং রিঙ্গো এর মতো বিশাল বিশাল আন্তর্জাতিক মানের তারকারা। তারা সেখানে সঙ্গিতের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশে দায়িয়েছিল। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান সেসময় আর দ্বিতীয়টি ছিলো না।
এছাড়া দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফকির আলমগীর, আব্দুল জব্বার, সমর দাস, ইয়ার মোহাম্মদ এর মতো তারকারা তাদের শব্দ শিল্পের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে বারবার জাগিয়ে তুলেছিল।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধে সংগীত শিল্পীরা অসামান্য অবদান রেখেছিল।