Site icon

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীত শিল্পীদের অবদান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীত শিল্পীদের অবদান

১৯৪৭ সালে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায় ভারত ও পাকিস্তান। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ভারত নামক দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। বর্তমান আমাদের বাংলাদেশ তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত ছিল। বাঙালি জাতীর নির্মম পরিহাস আবার পরাধীনতাকেই বরন করতে বাধ্য করে। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, ‍কৃষ, শিল্প সকল ক্ষেত্রেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট ছিল। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগন সোচ্চার হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন স্বাধীকারের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ কালরাতে নিরীহ-নিরস্ত্র জনগনের ওপর “অপারেশন সার্চলাইট” নামে নৃশংস গণহত্যা পরিচালনা করে। মুক্তিকামী বাঙালি জনতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। 

 

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথটা অতটা মসৃন ছিল না। দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপন লড়াইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। সকল শ্রেণী পেশার জনগন  মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখে। এই কঠিন ও সংকটকালীন মুহূর্তে সংগীত শিল্পীগন অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সংগীত শিল্পীরা রচনা করেছেন কালজয়ী অনেক গান। আহত সৈনিকদের আর্তনাদকে গর্জনে রুপান্তিরিত করেছেন শিল্পীগন তাদের গানের মাধ্যমে। তাদের গানের শব্দচয়ন থেকে সুর ও লিরিক্স এতটাই বিদ্রোহী, প্রতিবাদী ছিল যে, সাধারন ছাত্র-জনতা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি শিল্পীগন এবং জর্জ হ্যারিসনের মতো অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীগন সংগীতের মাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সিকান্দার আবু জাফর গীতিকার, সাংবাদিক ও বু্দ্ধিজীবী হিসেবে অকাতরে অবদান রেছেছেন। তিনি ছিলেন দৈনিক সমকাল পত্রিকার সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।  তার বিখ্যাত 

 ‘‘জনতার সংগ্রাম চলবেই, 

আমাদের সংগ্রাম চলবেই …

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ চলবেই চলবেই, 

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’’

 

‘রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া ……

তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া

তুমি বাংলা ছাড়ো।’’

 

এর মতো কালজয়ী রচনাগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বাড়িয়ে ছিল বহুগুন। তার জনতার সংগ্রাম চলবেই গানটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে এটা গণসংগীতে পরিণত হয়েছিল। 

 

সমর দাস বাংলা গানের জগতে একজন কিংবদন্তী সংগীত পরিচালক, সুরস্রষ্টা এবং ঢাকা বেতার কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকার লক্ষীবাজারে জন্ম নেয়া এই শিল্পী মুজিবনগর সরকারের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে লড়াইরত যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে কালজয়ী সব সংগীত প্রচার করতেন। সেসময় সমর দাস “পূর্ব ‍দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল”, নোওর তোলো তোলো, সময় যে হলো হলো, নোঙর তোলো তোলো” বিখ্যাত দুটি সংগীতের সুর করেন। 

স্বাধীনতা যুদ্ধে আব্দুল জব্বার কন্ঠশিল্পী হিসেবে অগ্রগণ্য অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় “জয় বাংলা বাংলার জয়, সালাম সালাম হাজার সালাম এর মতো জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নয় কণ্ঠ দিয়ে লড়াই করেছেন। তার গানে অনপ্রেরণায় অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আব্দুল জব্বার বাংলাদেশের ‍মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য নিরলশ পরিশ্রম করেছেন। ভারতের শহরে শহরে গান গেয়ে তার উপার্জিত প্রায় ১২ লক্ষ টাকা স্বাধীন বাংলা সরকারের তহবিলে জমা দেন। 

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি কালজয়ী সংগীত। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় ধরে গানটি স্বাধীনতার চেতনায় পুরো দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছিল। তার একটি উল্লেখযোগ্য গান তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে। তার গানগুলো যেন বারুদ। 

সংগীত যে মানুষের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭১। সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারত গানগুলো জাগিয়ে রেখেছিল জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহাকে। “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে…….” , আপেল মাহমুদের এই গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে বারংবার সম্প্রচার করা হতো। ঝিমিয়ে পড়া মুক্তিসেনাদের বুকে নতুন সাহস সঞ্চারিত হতো এই গানের মাধ্যমে। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে একসুতোয় নিয়ে এসেছিল কালজয়ী এই  গানটি। 

‘জয় বাংলা বাংলার জয়

জয় বাংলা বাংলার জয়

হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়

কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধ রাতে

নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়…’

গাজী মাজহারুল ইসলাম রচিত আনোয়ার পারভেজ এর সুর করা এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল জব্বার ও শাহনাজ বেগম। গানটিতে এমন সব শব্দচয়ন করা হয়েছে যে, পাক হানাদার বাহিনীকে বধ করতে সাথে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন এই গানটি শোনার জন্য। এই গানটি যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণভোমরা। 

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণদায়ক ছিল। বিশেষ করে 

কারার ঐ লৌহ কপাট

ভেঙে ফেল কর রে লোপাট

রক্ত জমাট শিকল পুজোর পাষাণ বেদী

ওরে ও তরুণ ঈষাণ

বাজা তোর প্রলয় বিষাণ

ধ্বংস নিশান উক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি ॥

এই গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও শক্তি দিয়েছে। অন্তরকে ভয়শূণ্য করে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়তে সহায়ত করেছে। মানবতার ফেরিওয়ালা নজরুল শোষন ও বিষম্যের বিরুদ্ধে তার কবিতা ও গানকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। 

এছাড়া নইম গহরের “নোঙর তোল তোল সময় যে হল হল” খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার “ছোটদের বড়দের সকলের” আব্দুল জব্বারের “সালাম সালাম হাজার সালাম” গোবিন্দ হালদার ও আপেল মাহমুদের “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে”,“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি”,  গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের “শোনো একটি মুজিবরের থেকে”, গানগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেরণাদায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতা অর্জনে সংগীত শিল্পীগন অবদান রেখেছেন। সম্মুখ যোদ্ধারা যখন ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তখনই সংগীত মুক্তিযোদ্ধোদের আলোর পথ দেখিয়েছে। আশার আলো জ্বালিয়েছিল সংগীতশিল্পীরা। হাল না ছাড়ার মানসিকতা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে সংগীত শিল্পীরা। 

বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের অনেক সংগীত শিল্পী মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গান রচনা করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে। পণ্ডিত রবিশংকর জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর নিউইয়র্কে সংগীতের আসর বসিয়েছেন। বাংলার স্বাধীনতার শিল্পীগন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনমত গঠনে সহায়তা করেছেন। সেই সাথে গানের মাধ্যম অর্জিত অর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য দান করেছেন। 

 

পরিশেষে একথা বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীত শিল্পীদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। 

আরও পড়ুন:

অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর বিশ্বে কীভাবে ছড়িয়েছিল

 

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

Exit mobile version