আজকের এই আর্টিকেলে বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে ১০টি বাক্য এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আপনাকে স্বাগতম। সম্পূর্ণ তথ্য পেতে আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ার অনুরোধ রইল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে এক বর্বরতম অধ্যায় হচ্ছে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা। জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। পাকিস্তান প্রশাসন নিশ্চিত পরাজয় জেনে জাতীর শ্রেষ্টতম মেধাবী এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনঁকশা বাস্তবায়ন করে। জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে এই বর্বরতম ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞে সহায়তা করে এদেশীয় রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর কর্মীগন। বাঙালী জাতীকে মেধাশূণ্য করার মানসে এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। একদিকে বিজয়ের আনন্দ আর অন্যদিকে শ্রেষ্ট মেধাবীদের হারানোর শোকে একাকার হয়ে গেছিল ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
বাংলা একাডেমী কর্তক প্রণীত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞায় মোটামুটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অনুরূপ সংজ্ঞা দিয়েছন। বুদ্ধিজীবী হলো এমন শ্রেণী ও পেশার মানুষ যারা বুদ্ধিক ক্ষমতার প্রয়োগ করে জীবীকা নির্বাহ করে এবং দেশ ও জনগণের ওপর তাদের বৌদ্ধিক প্রভাব প্রয়োগ করে দেশ ও জাতীকে সংস্কার ও সমৃ্দ্ধির পথে ধাবিত করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে ১০ টি বাক্য
১। দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক বা মানসিক শ্রম দিয়ে থাকেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। যেমন, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানিী, দার্শনিক, ডাক্তার প্রভৃতি।
২। বুদ্ধিজীবীরা জাতীর শ্রেষ্ট সন্তান। তারা জাতীর বিবেককে সমুন্নত রাখে।
২। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পক্ষে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনা করেন।
৩। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করে এদেশীয় রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী।
৪। বাঙালি জাতীকে মেধাশূণ্য করার লক্ষ্যে পাক বাহিনী এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে।
৫। বুদ্ধিজীবীদের গেস্টাপো কায়দায় চোখ-হাত বেঁধে টর্সার সেলে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
৬। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত হতেই বুদ্ধিজীবী হত্যার সূচনা। তবে সর্বাত্মকভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ডিসেম্বরের ১০-১৪ তারিখ সময়কালে।
৮। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, অনুদ্বৈপায়ন ভট্রাচার্য, সুখরঞ্জন সম্মাদার, মীর আব্দুল কাইয়ুম, ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, ডা. মোঃ আলিম চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা পারভীন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রনদপ্রাসাদ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ সহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবী একাত্তরে পাক বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণ করেন।
৯। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ’ মিরপুর, ঢাকা।
১০। ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে বাংলাদেশে এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়।
আরও পড়ুন..
মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন কে কে এ সম্পর্কে বিস্তারিত।
অপারেশন সার্চলাইট এর নীল নকশা কে তৈরি করেন
অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর বিশ্বে কীভাবে ছড়িয়েছিল
সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান
এখন প্রশ্ন হলো পাকিস্তানি হানাদাররা কেন বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল?
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তানি শোষন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় ছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা জাতীর বিবেককে জাগ্রত রেখেছিলেন। মানুষের চেতনায় সাম্য ও শান্তির বীজ বুনে ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাই বুদ্ধিজীবীদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত “অপারেশন সার্চলাইট” এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীকে মেধাশূণ্য করার প্রয়াস চালায়। আর এ কাজে অগ্রগামী ভূমিকায় ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। যুদ্ধের শেষেরদিকে তারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। আর এই বুদ্ধিজীবী নিধনে সহায়তা করে রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড মূলত একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছে তা সঠিক নির্ণয় সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় শহীদের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে নিহত বু্দ্ধিজীবীর সংখ্যা ১১০০-১২০০ এর মতো।
রাজশাহী বশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক শহীদ ড. সামসুজ্জোহা বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সেনার হাত থেকে আন্দোলনরত ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে দেশের স্বাধীকারের আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, বিখ্যাত নাট্যকার, ভাষাতত্ত্ববিদ, বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক, প্রবন্ধকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল খায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জৌাতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ও রাশিদুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিতের অধ্যাপক ও ঢাকা হলের প্রভোস্ট শরাফত আলী খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান খান নাদিম ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্র্যাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, সংস্কৃতের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও মনোবিজ্ঞানের মীর আব্দুল কাইয়ুম। চিকিৎসকদের মধ্যে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী, সহকারী সার্জন মোহাম্মাদ আজহারুল হক, দন্ত চিকিৎসক মোহাম্মদ শফী, আয়ুবৈদিক চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ ডা. যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, নুতন চন্দ্র সিংহ, রমনীকান্ত নন্দী সহ আরো অনেক চিকিৎসক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, দানবীর ও সমাজসেবক রনদাপ্রসাদ সাহা, শিক্ষাবিদ আবুল কালাম আজাদ, কবি মেহেরুন নেসা, আইনজীবী নাজমুল হক সরকার, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সহ আরো অনেক নাম না জানা বুদ্ধিজীবী একাত্তরে তাদের জীবন বলি দিয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীদের খুবই নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়। বেয়েনেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। চোখের ডাক্তারের চোখ তুলে নিয়ে, হার্টের ডাক্তারের হার্ট উপরে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। কারও এক হাত কারও দুই হাত কেটে হত্যা করা হয়েছে। শরীরে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন…
মুক্তিযুদ্ধে সংগীত শিল্পীদের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেখুন এই পোস্টে। মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা বিস্তারিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীরা কোথায় এবং কিভাবে আশ্রয় পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় উপাধি গুলো কি কি