পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে বিভিন্নভাবে শোষন করতে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে শোষন করতে থাকে। শোষনের পাশাপাশি তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ওপর নির্যাতন চালায়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন এসব বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে তীব্র প্রতিবাদ চালায়। এ বিক্ষিপ্ত আন্দোলনই ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যূত্থানে রূপ নেয়।
বাঙালির রাজনৈতিক উদ্দীপনায় শঙ্কিত হয় পাকিস্তান। মিথ্যা মামলায় আটক করে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের। তাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার ছাত্র সমাজ ফেটে পড়ে তীব্র প্রতিবাদে। ডাকসুর নেতৃত্বে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো গঠন করে Student Action Committee. নেতাদের মুক্তি আর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শুরু হয় ১৯৬৯ এর অভ্যূত্থান। নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভ পরিণত হয় বাংলার মুক্তির আন্দোলনে। মিছিল থামাতে গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হয় ছাত্রনেতা আসাদ। আসাদের মৃত্যু পুরো দেশের মানুষের মাঝে তৈরি করে সংগ্রামের আগুন। ১৫ ফেব্রুয়ারি বন্দি অবস্থায় নিহত হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক। তার মৃত্যুর সংবাদে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় ভাষন দেন মাওলানা ভাষানি। বলেন, দুই মাসের মধ্যে ১১ দফার বাস্তবায়ন এবং সকল রাজবন্দীর মুক্তি না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হবে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা নিহত হলে ক্ষুদ্ধ ছাত্র সমাজ সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে নেমে আসে রাজপথে। রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। আইয়ুব খান ক্ষমতা তুলে দেন ইয়াহিয়া খানের হাতে। ঘনিয়ে আস ৭০ এর নির্বাচন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের ঘটনাপ্রবাহঃ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে তার শাসনের এক দশক পূর্তিতে উন্নয়ন দশক পালন করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মধ্যে উক্ত দশকের শোষন নীতি ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। স্বল্পকালের মধ্যে এ প্রতিবাদ এক গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে, জন্ম নেয় ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান।
১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ ঢাকায় মিলিত হয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ (Democratic Action Committee) গঠন করেন। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, (মতিয়া ও মেননের গ্রুপ) ও ডাকসুর যৌথ উদ্যোগে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ছাত্ররা তাদের অধিকার আদায়ের জন্যে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফা মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা অন্তুর্ভুক্ত ছিল। ১১ দফা কর্মসূচি সব শ্রেণির মানুষের সমর্থন পায়। ডাকসু ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ে আন্দোলন আরও বড় আকার ধারন করে। ১৪ জানুয়ারি ডাকসু এর আহবানে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়।
আসাদুজ্জামান শহীদ হন। ২১ জানুয়ারি আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বহু লোক রাস্তায় নামে। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যূত্থান দিবস হিসেবে অভিহিত হয়। এদিন হরতাল পালিত হয়। এ দিন পুলিশের গুলিতে ঢাকায় স্কুল ছাত্র কিশোর মতিউরসহ কয়েকজন শহীদ হন এবং বহু লোক আহত হয়। এরপর পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিনা কারনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে। ফলে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সান্ধ্য আইন জারি ও নির্বিচারে গণহত্যা করেও আন্দোলন দমন করা যায়নি। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে আইয়ুব খান বিরোধী দলীয় নেতাদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। বিরোধী নেতৃবৃন্দ তা প্রত্যাখান করেন। আইয়ুব খান বুঝতে পারলেন যে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলন থামানো যাবে না। তাই ২১ ফেব্রু এক বেতার ভাষনে বলেনে যে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও রাজবন্দিদের মুক্তি দিবেন এবং তিনি আর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সহ সবাই মুক্তি পান। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক গণ সংবর্ধনায় পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়।
১৯৬৯ সালের ১০ ই মার্চ আইয়ুব খান রাওয়াল পিন্ডিতে গোল টেবিল বৈঠক আহবান করেন। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দাবি পুনরায় ব্যক্ত করেন। দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি বৈঠক বর্জন করেন আন্দোলন আরও বেগবান করেন। ফলে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এভাবেই গণ অভ্যূত্থান সফলতা লাভ করে।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যূত্থানের কারনঃ
একক কোন কারণকে কেন্দ্র করে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান সংঘটিত হয় নি। এর পেছনে নানাবিধ কারণ নিহিত ছিল।
সামরিক কারনঃ
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে গণতান্ত্রের ধারাকে রুদ্ধ করেন। ফলে দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ আইয়ুব প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যূত্থানের অন্যতম প্রধান কারন।
মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাঃ
১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে সর্বজনীন ভোটাধিকারের পরিবর্তে মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা হয়। এতে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে কতিপয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা সপে দেওয়া হয়। এর ফলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃ্দ্ধি পেতে থাকে এবং জনগনের সাথে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। এমতাবস্থায় জনগণ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয় এবং তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গণঅভ্যূত্থান ঘটায়।
সকল স্তরে বৈষম্যনীতিঃ
আইয়ুব সরকারের উন্নয়ন দশকে দুই অঞ্চলের বৈষম্যনীতি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় রাজধানী ছিল করাচি। তার উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। আইয়ুব সরকার পাকিস্তানের রাজধানী স্থানান্তর করেন ইসলামাবাদে। তার উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। আর পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকার উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ কোটি টাকা। এছাড়া শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, শিল্প গবেষণা, চাকরিসহ সবক্ষেত্রে দুুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
নিয়োগের ক্ষেত্রে | পশ্চিম পাকিস্তান (জনসংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লক্ষ) | পূর্ব পাকিস্তান (জনসংখ্যা ৭ কোটি ৭০ লক্ষ) |
কেন্দ্রীয় বেসামরিক চাকরি | ৮৪% | ১৬% |
স্থল বাহিনী | ৯৫% | ৫% |
নৌ বাহিনী | ৮১% | ১৯% |
বিমান বাহিনীর বৈমানিক | ৯১% | ৯% |
ডাক্তার | ১২,৪০০ জন | ৭৬০০ জন |
সশস্ত্র বাহিনী | ৫০০,০০০ জন | ২০,০০০ জন |
পাকিস্তান এয়ারলাইন্স | ৭০০০ জন | ২৮০ জন |
পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ঔদাসীন্যতাঃ
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানায় সৈন্য মোতায়েন করা হলেও পূর্ব পাকিস্তান সীমানা অরক্ষিত থাকে। ফলে এ অঞ্চলের জনগণ নিরাপত্তার অভাববোধ করে এবং আলাদা সৈন্য বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ার ভয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের এ দাবি উপেক্ষা করে। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে। যা শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যূত্থানের রূপ নেয়।
ছাত্রনেতা, আসামি ও শিক্ষকের মৃত্যুঃ
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। অতঃপর ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুুঁচিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে। আর এসব অন্যায় হত্যাকাণ্ডের উত্তাপ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আইয়ুব সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
আমলা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ
আইয়ুব মোনায়েম শাসনকালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনে আমলাদের ক্ষমতা সীমাহীনভাবে বেড়ে যায়। এসব আমলা ও সেনাসদস্যরা অতি নগ্নভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতেন। ফলে সচেতন জনগন বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।
স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিঃ
মোটাদাগে বলা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। আর এই লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানসহ সিন্ধু, বেলুচিস্তানের স্বায়ত্তশাসন কামী জনগন ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন করে।
সরকারী দমননীতি ও পুলিশী নির্যাতনঃ
সমগ্র পাকিস্তানের গণতন্ত্রকামী জনগন যখন গণতন্ত্রের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে তখন পাকিস্তানি সরকার তাদের এই দাবিকে দমন করার জন্য নৃশংস পুলিশী নির্যাতন চালায়। নির্যাতন যতই বাড়তে থাকে আন্দোলন ততই বেগবান হয়।
জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার প্রসারঃ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার জন্ম হয়। এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা করা হলে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও বেশি গতিশীল হয়। ১৯৬৯ সালে জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারন করে।
দূর্নীতির প্রসারঃ
আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তানে দূর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটে। আমলা, সেনাবাহিনী ও মৌলিক গণতন্ত্রীরা এই দূর্নীতির বিস্তার ঘটান। এই দূর্নীতির কারনে জনগন পাকিস্তান সরকারের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের ফলাফলঃ
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারঃ
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের ফলে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার অবসান হয়। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাগণ ১৯৬৮ সালে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে অনড় ও অটল। ফলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
রাজবন্দীদের মুক্তিঃ
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থান সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ক্ষুদ্ধ জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ফলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত সকল রাজবন্দীদের বিনা শর্তে মুক্তি দেয়।
গোল টেবিল বৈঠক আহবানঃ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের তীব্রতা প্রশমনের জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক গোল টেবিল বৈঠক আহবান করেন। এ বৈঠকে ৬ দফা প্রত্যাখান হয়। ফলে গণআন্দোলন আবারও তীব্ররূপ ধারণ করে এবং প্রশাসন নিশ্চল হয়ে পড়ে। আবার ১৯৬৯ সালের ২০ মার্চ আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে রাওয়ালপিন্ডিতে পুনরায় গোল টেবিল বৈঠক আহবান করা হয়। এতে তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমন- প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা। আইয়ুব খান কর্তৃক আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকে গৃহীত তিনটি বিষয়ে আইয়ুব খান ও বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ একমত হয়। কিন্তু ছয়দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে না নিলে আওয়ামী লীগ গোল টেবিল বৈঠক বর্জন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এ সময় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে।
আইয়ুব খানের পতনঃ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল হলো স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন। জনগনের আন্দোলনের চাপ সামলাতে না পেরে আইয়ুব খান দিশেহারা হয়ে পড়েন। অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে আইয়ুব খান ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঘোষণাঃ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধিকার চেতনায় জাগ্রত করে তোলে। এ কারনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে। তাই রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিঃ
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন পাকিস্তনের রাজনীতিতে বিশেষ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়। আর জাতীয়তাবোধের ওপর ভিত্তি করেই তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেয় এবং ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য।
স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা তৈরিঃ
গণ-অভ্যূত্থানের ফলে জনগনের মধ্যে স্বৈরাচারবিরোধী মানসিকতা গভীরভাবে গ্রোথিত হয়। বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য জনগণ সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকারের জন্যও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারির ছুটি পুনর্ববহালঃ
১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থানের ফলে জাতীয় চেতনার প্রতীক ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পূর্বের মর্যাদা ফিরে পায়। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ২১ ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরক আইন জারির পর এ ছুটি বাতিল হয়ে যায়।
শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃ্দ্ধিঃ
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যূত্থানের পর শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। শেখ মুজব সর্বস্তরের জনগণের নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শেখ মুজিবের পর ১৯৬৯ সালেল ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ রেসকোর্স ময়দানে এক গণসংবর্ধনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন।
আইয়ুব সরকারের অবসানঃ
কঠোর আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য গভর্ণর মোনায়েম খানকে সরিয়ে ড. এস. এন হুদাকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। এ সময় গণ-অভ্যূত্থান কিছুটা শান্ত হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ সামরিক আইন চালু করে। এর ধারাবাহিকতায় আইয়ুব খানের পতনের পর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনঃ
প্রচন্ড চাপে পাকিস্তান সরকার সাধারন নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন পায়। প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন পায়।েএই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাঃ
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যূত্থানের ফলে বাঙাল জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। যার ফলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ শহীদের তাজা প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করলে বাঙালি তাদের ঐতিহ্য ফিরে পায়। বাঙালিরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দঁড়ানোর সুযোগ পায়।
স্বাধীনতা অর্জনঃ
পাকিস্তান সামরিক জান্তা এ গণ-আন্দোলনকে স্তব্ধ করার শত প্রচেষ্টা চালিয়েও সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। এ আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার যে মহান ব্রত নেয় তা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাস্তব রূপ লাভ করে।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, ১৯৬৯ সালের তাৎপর্য অপরিসীম। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্র, জনতা, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুসহ সব বন্দি নেতাদের মুক্তির জন্য িঐক্যবদ্ধ হয়। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। বিশ্ব দরবারে বাঙালিরা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।