মুজিবনগর সরকারের চারটি অবদান

মুজিবনগর সরকারের চারটি অবদান শীর্ষক আর্টিকেল আপনাকে স্বাগতম। এই আর্টিকেলে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার নাম মুজিবনগর কিভাবে হলো, মুজিবনগর সরকার কেন গঠিত হয়েছে, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, মুজিবনগর সরকারের চারটি অবদান এবং মুজিবনগর সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়গুলো জানতে আর্টিকেলটি ধৈর্য্য সহকারে পড়ার ‍অনুরোধ রইল। 

মুজবনগরঃ

মুজিবনগর এর পূর্বনাম বৈদ্যনাথতলা। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা মেহেরপুরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার এই মুজিবনগরে গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার এখানে শপথ গ্রহন করে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই জায়গার নাম মুজিবনগর রাখেন। জায়গাটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখানে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স এবং মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। 

আরও পড়ুনঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীত শিল্পীদের অবদান

৫ জন বুদ্ধিজীবীর নাম।

মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন কে কে এ সম্পর্কে বিস্তারিত।

জাতীয় চার নেতার নাম ও পদবী

অপারেশন সার্চলাইট এর নীল নকশা কে তৈরি করেন

মুজিবনগর সরকার কেন গঠিত হয়েছিলঃ

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের নীতি গ্রহন করে। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমের সাথে পূর্বের বৈষম্য যখন চরম আকার ধারন করেছিল। পূর্ব বাংলা তখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে উত্তাল। ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তান প্রশাসন পূর্ব বাংলার আওয়ামীলীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোল ডাক দেন। পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার আন্দোলনকে দমাতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে গণহত্যা পরিচালনা করে। ২৬ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ফলে শুরু হয় সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ। আর এই মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা, মুক্তিবাহিনী গঠন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং সহযোগিতার জন্য তাজউদ্দিন আহমদের পরিকল্পনায় “মুজিবনগর সরকার” নামে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের রাজধানী কলকাতায় হওয়ায় একে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও বলা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। 

মুজিবনগর সরকারের গঠন-কাঠামোঃ

সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাজউদ্দিন আহমদ ১০ই এপ্রিল আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় অধিবেশন আহবান করেন। উক্ত অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং বৈদেশিক সহযোগিতার জন্য মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি থাকায় তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খন্দরকার মোশতাক আহমেদ কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। জেনারেল এম এ জি ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। 

মুজিবনগর সরকারের চারটি অবদান

মুক্তিবাহিনী গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনাঃ

মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুক্তিবাহিনী গঠন করে। মুজিবনগর সরকার মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, কর্নেল আব্দুর রবকে চীফ অব স্টাফ এবং ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার কে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকেন তাজউদ্দিন আহমেদ স্বয়ং নিজে।

মুক্তিবাহিনীকে  দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল: ১) নিয়মিত বাহিনী ২)অনিয়মিত বাহিনী।ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনী নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গঠিত। পুরো দেশকে ১১টি সেক্টর এবং ৬৪টি সাব সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেট ফোর্সে বিভক্ত করা হয়েছিল। এই নিয়মিত বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। সেনাবাহিনী। অনিয়মিত বাহিনীর মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগন। এই বাহিনীকে গণবাহিনীও বলা হয়ে থাকে। মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের জন্য ভারতকে রাজি করান। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। 

আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ঃ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিক মিশন পরিচালনা করে। মুজিবনগর সরকার ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিক, রাশিয়া সহ বিশ্বের অনেক দেশের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকে। মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতায় ভারত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়। ভারত মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। ইংল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। আমেরিকার জনগন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে গেলেও মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার কারনে আমেরিকার সাধারন জনগন বাংলাদেশের পক্ষে রাজপথে মানববন্ধন করে। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেঃ

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলার জনগনের ওপর বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে। অপারেশন সার্চলাইটে বাংলার নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগনের ওপর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। পুরো নয় মাস জুড়ে পাক সেনারা বাংলার ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করে। জাতীকে মেধাশূন্য করে। জাতীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। প্রায় দুলক্ষ নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন করেন। মুজিবনগর সরকার পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন। সারাবিশ্বের মানুষ বাংলায় সংঘটিত বর্বরতা জানতে পারে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টি হয়। 

শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলাঃ

মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নিরীহ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সহ বাংলার পাশ্ববর্তী ভারতের প্রদেশগুলোতে শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়। মুজিবনগর সরকার শরণার্থীদের জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ  ও সংগঠনের নকট থেকে অর্থ সহায়তার জন্য আবেদন জানায়। সারা বিশ্ব হতে দাতা রাষ্ট্র ও সংগঠন মুজিবনগর সরকারের তহবিলে অর্থ ও ত্রান সহায়তা করতে থাকে। শরণার্থীদের তালিকাভূক্ত করে সুষ্ঠুভাবে ত্রান কার্যক্রম পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার। এএইচএম কামরুজ্জামান মুজিবনগর সরকারের ত্রান ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করেন। 

আরও পড়ুন:

অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর বিশ্বে কীভাবে ছড়িয়েছিল

সাইমন ড্রিং এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট কত দফা ঘোষণা করে এবং দফাগুলো কি কি। বিস্তারিত।

যুক্তফ্রন্ট কেন গঠিত হয়েছিল
মুজিবনগর সরকার সম্পর্কিত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলিঃ

প্রশ্নঃ মুজিবনগরের পূর্ব নাম কি ছিল?

উত্তরঃ মুজিবনগরের পূর্ব নাম ছিল বৈদ্যনাথ তলা। 

প্রশ্নঃ ১৯৭১ সালের কত তারিখে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়?

উত্তরঃ ১৯৭১ সালের ১০ই এ্রপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেন।

প্রশ্নঃ ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কে?

উত্তরঃ আব্দুল মান্নান এম.এন।

প্রশ্নঃ ১০ ই এপ্রিল কি দিবস?

উত্তরঃ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস।

প্রশ্নঃ মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর কোথায়?

উত্তরঃ ৮ নং থিয়েটার রোড, কলকাতা, ভারত।

প্রশ্নঃ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রনালয় কয়টি ছিল?

প্রশ্নঃ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রণালয় কয়টি ও কি কি?

উত্তরঃ মুজিবনগর সরকারের ১২টি মন্ত্রনালয়। মন্ত্রনালয়গুলো হলো, 

প্রতিরক্ষা ,পররাষ্ট্র ,অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য ,মন্ত্রিপরিষদ ,সাধারণ প্রশাসন বিভাগ,স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়,তথ্য ও বেতার ,স্বরাষ্ট্র ,ত্রাণ ও পুনর্বাসন ,সংসদ বিষয়ক ,কৃষি ও প্রকৌশল বিভাগ।

প্রশ্নঃ মুজিবনগর সরকারের অর্থ মন্ত্রী কে?

উত্তরঃ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী।

মুজিবনগর সরকারের সেনাপ্রধান কে ছিলেন?

উত্তরঃ জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি।

আরও পড়ুনঃ

যুক্তফ্রন্ট কখন গঠিত হয় এবং এর আদ্যোপান্ত।

মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসনের অবদান।

শহীদ মিনার কিসের প্রতীক

মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীরা কোথায় এবং কিভাবে আশ্রয় পেয়েছিল।

 মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা বিস্তারিত।

মুক্তিযুদ্ধে সংগীত শিল্পীদের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেখুন এই পোস্টে।

Scroll to Top
Verified by MonsterInsights