অপারেশন সার্চলাইট সাংকেতিক নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদশের ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে আম-জনতার ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। এই আর্টিকেলে অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর বিশ্বে কীভাবে ছড়িয়েছিল সে সম্পর্কে তুলে ধরে হয়েছে। আর্টিকেলটি তাই মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষন ও শরণার্থীদের দুর্ভোগ পাকিস্তান প্রশাসন গোপন রাখতে চেয়েছিল। সে লক্ষে পূর্ব বাংলার রেডিও, টেলিভিশন স্টেশন ও সংবাদপত্র অফিসগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে বন্ধ করে দেয়। অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়।
এ সময় জীবন বাজি রেখে অনেক বিদেশি সাংবাদিক যুদ্ধকালীন সংবাদ সংগ্রহ করেছেন এবং তা বহির্বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এতে বহির্বিশ্ব প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছে। আমাদের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারকৃত এসব খবর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছে। সাংবাদিকদের সেসব আলোকচিত্র, ডকুমেন্টরি ও ভিডিও ফুটেজ সময়ের পরিক্রমায় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল।
সাইমন ড্রিংঃ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিং লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া অঞ্চলে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছিলেন। হটাৎ তাকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলী করা হয়। ১৯৭১ এর ৬ই মার্চ তিনি ঢাকায় আসলেন। পরদিন ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষন প্রত্যক্ষ করলেন। সাইমন ড্রিং বাংলা জানতেন না। কিন্তু ৭ই মার্চ তিনি জনতার স্রোত, জনগনের উৎসাহ-উৎকণ্ঠা এবং তাদের শরীরি ভাষা দেখে বুঝলেন এখানে ঐতিহাসিক কিছু ঘটতে চলেছে। তিনি ৭ই মার্চ শুধু একটি কথা বুঝলেন, পূর্ব বাংলা “জয় বাংলা” চায়।
এরপর ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে দেখতে এরই মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার ও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এদিকে ক্ষণে ক্ষনে ঢাকার পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশ বিক্ষোভ, হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল
এরই মধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ হলে সাইমন ডিং বুঝতে পেরেছিলেন ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে এখানে। তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকতেন। এ রাতে সকল বিদেশি সাংবাদিক ও অতিথিদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মিলিটারি নিরাপত্তায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। হোটেল থেকেই গুলি আর কামানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আগুনের স্ফূলিঙ্গ দেখা যাচ্ছিল।
পরদিন সকালেই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কথা বলে জোরপূর্বক বিমানে তুলে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই গা ঢাঁকা দেন।২৭ শে মার্চ কারফিউ উঠে গেলে সাইমন ড্রিং ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ঢাকার অলি-গলি বিভিন্ন জায়গা। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিরাপত্তার স্বার্থে বৃটিশ হাইকমিশনের সহায়তায় ঢাকা থেকে ব্যংকক পৌছান।
সেখানে বসে যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় Tank Crush Revolt in East Pakistan শিরোনামে পাকিস্তানি গণহত্যার নৃশংস বর্বরতার খবর পাঠান। প্রতিবেদনটি ৩০শে মার্চ প্রকাশিত হয়। সেখানে সাইমন ড্রিং লেখেন “আল্লাহর নামে অখন্ড পাকিস্তান রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। ২৪ ঘন্টায় এখানে প্রায় ৭০০০ মানুষ মারা গেছে। নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর এ বর্বরতা চালানো হয়”। তার সেই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাঙালিরে স্বাধিকারের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠিত হয়।
পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশে ভারত সীমান্তে শরণার্থীদের নিয়ে সংবাদ প্রচার করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সংবাদ প্রচার করেন। এতে মুক্তিযোদ্ধারাও অনুপ্রানিত হন। আমাদের বিজয়ের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
আর্চার কেন্ট ব্লাডঃ
তখন ঢাকায় সকল বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের ওপর কড়া নজরদারি চলছিল। তথ্য আদান প্রদানে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে ইয়াহিয়াকে সাজোয়া যান ও গোলাবারুদ দিয়েছিল।
কান্ট পড়েছেন এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে। কান্ট মানবতার এমন ন্যাক্কারজন অবমাননা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি ভয় ভেঙে বিবেক, মানবতা ও বাঙালির পক্ষে কাজ শুরু করলেন। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে আর্চার কেন্ট ব্লাড মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন।
আরও পড়ুন: শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে ১০ টি বাক্য মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন কে কে এ সম্পর্কে বিস্তারিত। জাতীয় চার নেতার নাম ও পদবী মুজিবনগর সরকারের চারটি অবদান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীত শিল্পীদের অবদান ৫ জন বুদ্ধিজীবীর নাম।
৬ এপ্রিল আর্চার কেন্ট ব্লাড যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে টেলিগ্রাম পাঠালেন, “ আমাদের সরকার গনতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে, মানবতার পক্ষে আমাদের সরকার পরাজিত হয়েছে, পাকিস্তান যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে আমাদের সরকার গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে, আমাদের সরকার সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও ন্যায়ের বাণী প্রচার করলেও পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে যেখানে কিনা সোভিয়েত ইউনিয়ন গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে আছে, আমি এবং আমরা আমেরিকা সরকারের পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে সরকারের মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষন করছি, এবং আশা করছি আমাদের সরকারের নীতির পরিবর্তন হবে”।
আর্চার কেন্ট ব্লাড ঢাকার তথ্য সংগ্রহ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে, “Selective Genocide”. নামে টেলিগ্রাম পাঠান। অর্থাৎ আর্চার কেন্ট ব্লাডই প্রথম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকে গণহত্যা বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার করেন।
ঢাকার খবর সংগ্রহ করে আমেরিকান পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়মিত পাঠাতেন। তিনি এক পর্যায়ে লিখেছিলেন, “আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, অন্ধকারে এককি কতই চিৎকার করব, কিন্তু আমি হতাশ নই, আমি একদিন এই নিরবতার বাঁধ ভাঙবই”।
সত্যিই তাই হলো। দুদিন বাদেই আমেরিকার হোয়াইট হাউজ থেকে ব্লাডের প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে গেল। গোপনে এই ব্লাড টেলিগ্রাম এবং পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার ভয়াবহ চিত্র ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বী এডওয়ার্ড কেনেডির হাতে এসে পড়ল। পুরো যুক্তরাষ্ট্রে তখন নিক্সন-কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড়। এবং এ ঘটনা পুরো বিশ্বের কাছে খুব দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছিল।
এভাবে আর্চার কেন্ট ব্লাড আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী একজন বীর হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার খবর সারা বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসঃ
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দেনিক “The Sunday Time” ১৩ জুন ১৯৭১ সালে “The Genocide” নামে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিখ্যাত সাংবাদিক নেভিল অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার বর্বর চিত্র সরেজমেনে পরিদর্শন করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনই জানতো না পূর্ব পাকিস্তানে কি চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যাকে পাকিস্তান প্রশাসন আড়াল করে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। পূর্ব পাকিস্তান হতে সব দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বিতাড়িত করে দেন। সেখান রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র অফিসগুলোতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বন্ধ করে দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে পাকিস্তান সরকার প্রচার করতে থাকে। পাকিস্তান এ নিয়ে বিশ্বে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে শান্ত ও স্বাভাবিক তা বিশ্ববাসীর কাছে জানানোর জন্য আট জন পাকিস্তানি সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই সাংবাদিকরা নিজের বিবেককে বিক্রি করে দিয়ে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ মতো খবর প্রচার করে। কিন্তু একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি হলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। তিনি ছিলেন সত্য প্রচারে নির্ভীক। তিনি একই সাথে পাকিস্তানের “The Morning News” এর সহঃ সম্পাদক এবং যুক্তরাজ্যের “The Sunday Time” পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাত ছিলেন। তিনি জানতেন যদি তিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করেন তাহলে পাকিস্তান প্রশাসন তাকে ও তার পরিবারকে শেষ করে দিবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সত্য প্রকাশের জন্য যদি দেশত্যাগও করতে হয় তবে তিনি তাই করবেন।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস যুক্তরাজ্যের “The Sunday Time” পত্রিকার সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রকৃত ঘটনা সব খুলে বলেন। হ্যারল্ড ইভান্স তার প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগ্রহ দেখান। কিন্তু অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তার পরিবারকে পাকিস্তান থেকে সরাতে হবে। নতুবা প্রাণ নাশের আশংকা রয়েছে। অ্যান্থনির কথা মতো তার পরিবার যুক্তরাজ্যে পৌছালে তারপরের দিন সেই বিখ্যাত প্রতিবেদনটি সংবাদপত্রে গুরুত্বের সাথে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। সারাবিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী খোদ ইন্দিরা গান্ধীও খুবই মনোযোগ সহকারে প্রতিবেদনটি পড়েন। তিনি এতটাই আবেগাপ্লুত হন যে, ভারতকে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে যদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি ইউরোপ ও রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে দেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বিখ্যাত প্রতিবেদন থেকে পাকিস্তান প্রশাসনের ও নজর এড়ায় নি। পাকিস্তান সরকার এতটাই ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন যে, এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে অভিহিত করেন। ভারতের চক্রান্ত বলে বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার করতে থাকেন।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের এমন সাহসী ভূমিকার কারনে বিশ্ববাসী বাংলদেশে সংঘটিত গণহত্যার খবর জানতে পেরেছিল। সারা পৃথিবী বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিল। বাংলার মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুন।
উইলিয়াম মার্ক টালিঃ
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন দেশি-বিদেশী নানা শ্রেনি পেশার মানুষ। কেউ সরাসারি রণাঙ্গনে, কেউ বিদেশি কূটনৈতিক মিশনে, কেউ সাংবাদিকতায়, আবার কেউ সঙ্গীতের মাধ্যমে। তাদেরেই একজন সাংবাদিক উইলিয়াম মার্ক টালি।
উইলিয়াম মার্ক টালি বৃটিশ ভারতের কলকাতায় জন্ম নেয়া বিবিসির (British Boardcasting Corporation) একজন বিখ্যাত সাংবাদিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিবিসির দক্ষিন এশিয়া বিষয়ক সংবাদ দাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মানুষ বিবিসির সংবাদকে বিশ্বাস করত। মার্ক টালি ছিলেন বাঙালির আশার আলো।
তৎকালীন রেডিওতে তার কণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য তিনি রেডিওতে ঘোষনা দিতেন। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পাওয়ার স্টেশন দখল, পাকিস্তানের গাড়ি বহরে হামলা, সাজোয়া যান ধ্বংস, সেতু উড়িয়ে দিয়ে পাকবাহিনীকে কোনঠাসা করা, পাক যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস প্রভৃতি সাফল্যগাথা তিনি রেডিওতে প্রচার করতেন।
আরও পড়ুন:
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে ১০ টি বাক্য
তিনি বলেন, বাঙালিদের ওপর হামলা করে পাকিস্তান বিশাল ভুল করেছে। এ ভুলের জন্য বাঙালিরা ইয়াহিয়ার গদিতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ আগুনে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের গদি পুড়ে ছাই হবে।
বাঙালি পিনপতন নিরবতা নিয়ে তার কথা রেডিওতে শুনতেন। পাক বাহিনীর বর্বরতা সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ফিনিক্স পাখি, তাকে হারানো কখনোই সম্ভব নয়। মার্ক টালি সরেজমিনে প্রকৃত ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করে তুলে ধরতেন।
মার্ক টালি ২৫শে মার্চের গণহত্যা পত্যক্ষ করেছিলেন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান পুরো দেশকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল। সমগ্র দেশ ভুতের রাজ্যে পরিনত হয়েছিল। মার্ক টালি শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা সারা বিশ্বের নিকট অকপটে প্রচার করতেন।
সিডনি শানবার্গঃ
১৯৭১ সালে যে কয়জন বিদেশী সাংবাদিক বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যার বর্বরতা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন সিডনি শানবার্গ তাদের অন্যতম। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যেদিন বর্বর পাশবিক হামলা পরিচালন করে সেদিন তিনি ঢাকাতে ছিলেন। ২৭শে মার্চ সিডনি শানবার্গ সহ আরো ৩৫ জন সাংবাদিককে জোর পূর্বক বিমানে তুলে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়।
তিনি এই বর্বরতার চিত্র তার লেখনির মাধ্যমে ২৮ মার্চ ১৯৭১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউিইয়র্ক টাইম পত্রিকায় In Dacca, Troops Use Artillery to halt revolt শিরোনামে অতি গুরুত্বের সাথে প্রচার করেন।
বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি গণহত্যাকে তিনি নাম দেন “পাইকারী হত্যাকান্ড” নামে।
পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার খবরে, “বিদ্রোহ দমাতে সৈন্যরা কামান দাগাচ্ছে”, “পূর্ব পাকিস্তানে কামানের বিরুদ্ধে লাঠি ও বল্লম” এভাবে শিরোনম করে তিনি নিউিইয়র্ক টাইমসে তিনি সংবাদ প্রচার করেন।
বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাঙ্গা থাকায় তিনি বাংলাদেশে সীমান্তে খবর সংগ্রহ করতেন। শরণার্থীদের ভয়াবহ কষ্টের চিত্র তুলে ধরতেন।
“Pakistan Divided” নামে তিনি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই প্রতিবেদনে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর শোষন-বৈষম্য, পাক বাহিনীর বর্বরত, বাঙালিদের স্বাধিকার কেন যৌক্তিক বিষয়গুলো তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তিনি এরকম প্রায় চল্লিশটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সিডনি শানবার্গ
সত্য ও সাহসী সাংবাদিকতার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় তিনি পরম বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছেন।
এভাবে বিদেশী সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের বাংলাদেশের গণহত্যার খবর প্রচার করার কারনে পাকিস্তানের নৃশংসতা সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল
আরও পড়ুনঃ মুজিবনগর সরকারের সদস্য ছিলেন কে কে এ সম্পর্কে বিস্তারিত। জাতীয় চার নেতার নাম ও পদবী মাদার তেরেসা সম্পর্কে ১০ টি বাক্য মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসনের অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীরা কোথায় এবং কিভাবে আশ্রয় পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা বিস্তারিত।